ক্যালসিয়াম আমাদের দেহের একটি অতি প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান। এই ক্যালসিয়ামের একটি বড় অংশ আমরা পাই দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে। তাই আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। কিন্তু এ ব্যাপারে অনেকেই খুব একটা ভাবতে আগ্রহী হন না। আর উঠতি বয়সীরা তো আরও উদাসীন। তারা অনেকে ক্যালসিয়ামের অভাবে ভুগছেন। আর যখন তারা ক্যালসিয়াম গ্রহণে আগ্রহী হন, তখন বেশ অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়।
এখানে ক্যালসিয়াম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
দেহে ক্যালসিয়ামের কার্যকারিতাঃ
* হাঁড় মজবুত করে।
* পেশীর সংকোচন এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ ঠিক রাখে।
* রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
* হরমোন নিঃসরণ ও দেহের বিভিন্ন রকম কোষের বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
* দেহের ভিতরে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না এবং কোথাও কেটে বা ছিঁড়ে গেলে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে।
* রাসায়নিক দূষণ থেকে দেহকে রক্ষণ করে। ভারী ধাতুর বিষক্রিয়া থেকে দেহকে বাঁচাতে ক্যালসিয়াম অন্যতম উপাদান। বিশেষত যারা কল-কারখানায় কর্মরত বা শিল্প এলাকায় বসবাস করেন। ঢাকার মতো যে সব শহরে হাওয়া বিপুল পরিমাণ সীসা ঘুরে বেড়ায়, সে সব শহরের মানুষের নিয়মিত ক্যালসিয়াম খাওয়া প্রয়োজন।
* অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ হতে ইনসুলিন নিঃসৃত হতে সাহায্য করে ফলে ডায়াবেটিস এবং এর কারণে চোখ, কিডনী, হৃদযন্ত্র বা ত্বকের সমস্যা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ঠিক রাখুন। দেহের ভিতরে ক্যালসিয়ামের মূল আবাস হল হাঁড় ও দাঁত। একই সাথে রক্তেও কিছু পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে। রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত হওয়া জরুরী। কেননা এখান থেকেই শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্যালসিয়াম বণ্টন হয়। রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কমে শরীরের চাহিদা মেটাতে হাঁড়ে সঞ্চিত ক্যালসিয়াম রক্তে আসতে থাকে যার ফলে হাঁড় ক্ষয় শুরু হয়। রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ঠিক রাখলে হাঁড় ও দাঁত মজবুত থাকে।
মেয়েদের বেশি করে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়ঃ
* অস্থিতে ক্যালসিয়ামের সমতা বজায় রাখে হরমোন। হরমোনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তারতম্যের জন্য ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি বেশি করে হয়।
* খনিজ পদার্থ ও কোষ-কলা অস্থির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ দুই উপাদানের উৎপত্তি এবং ক্ষয়ের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় হরমোন ও ভিটামিন ডি দ্বারা।
* জন্মবিরতিকরণ বড়ি ক্যালসিয়ামের ঘাটতির কারণ হতে পারে। তাই এসব খাবার বড়িও নিয়মিত খেয়ে যাওয়া উচিত নয়।
* অস্থি ক্ষয় ও অস্থি তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্যহানি ঘটার কারণেই অস্টিও পোরোসিসের সূত্রপাত হয়। ফলে সামান্য আঘাতেই হাঁড়ে চিড় ধরা, হাঁড় ভাঙা থেকে শুরু করে একেবারে চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এত নিঃশব্দে এর আগমন ঘটে যে, আমরা বুঝতেই পারি না আমাদের ক্যালসিয়াম ঘাটতির কথা।
ওষুধ ও ক্যালসিয়াম ঘাটতিঃ
* এ্যান্টাসিড, অবসাদ কমাবার ওষুধ, ডাইইউরেটিকস (DIURETICS) বা পানি কমাবার ওষুধ এপিলেন্সির ওষুধ, বেদনানাশক ওষুধ দীর্ঘদিন সেবনের মাধ্যমে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
* মানসিক অবসাদ ও ডিপ্রেশনে ভুগছেন এমন অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ক্যালসিয়ামের অভাবে ভুগছেন তিনি।
* উচ্চ রক্তচাপ ও অস্থির ক্যান্সার দেখা দিতে পারে ক্যালসিয়ামের দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতিতে।
* এ্যাকজিমা জাতীয় চর্মরোগ, মানসিক অস্থিরতা, অল্পতেই মেজাজ বিগড়ে যাওয়া,নখ, মাংস পেশীর খিঁচ ধরা ইত্যাদি ক্ষেত্র বিশেষে ক্যালসিয়ামের ঘাটতির কারণে দেখা দেয়।
ক্যালসিয়াম ও খাদ্যাভ্যাসঃ
* নিয়মিত বেশি পরিমাণে প্রাণিজ আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য ডায়েটারি ফ্যাট। রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। প্রাণিজ আমিষ শরীরে প্রচুর ফসফরাস উৎপন্ন করে, যা ফলশ্রুতিতে প্রস্রাবের সাথে ক্যালসিয়ামকে বের করে দেয়। বিশেষভাবে তৈরি ও সংরক্ষণ করা খাদ্যদ্রব্য ও একই কাজ করে।
* সমীক্ষায় দেখা গেছে, পঞ্চাশোর্ধ বয়সে যারা নিরামিষ খান, আমিষভোজীদের চেয়ে তাদের দেহে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ভাল থাকে।
* অন্ত্রে ক্যালসিয়াম আত্তীকরণে বাধা দেয় এ্যালুমিনিয়াম, এন্টাসিড ট্যাবলেট, বেকিং পাউডার, চা, টুথপেস্ট, বিট লবণ থেকে এ্যালুমিনিয়াম আমাদের দেহে প্রবেশ করে। তাই এসব পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করাই শ্রেয়। এ্যালুমিনিয়ামের পাত্র ব্যবহার করা উচিত নয়।
* সোডা ও কোমল পানীতে খাবেন, চিনি ও ফসফেট থাকে, যা ক্যালসিয়াম আত্তীকরণে বাধার সৃষ্টি করে। এরা দেহে ক্যালসিয়ামের ব্যবহারেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
* দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যে ক্যালসিয়াম আছে। তবে এরই সাথে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারও খাওয়া উচিত। কেননা প্রাণিজ খাদ্য হিসেবে দুধেও ফসফরাস থাকে যা ফসফেট তৈরি করে তাই দুধ ও অন্যান্য খাবারের মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকা উচিত।
ক্যালসিয়ামের উৎস :
মাছ | মাংস ও অন্যান্য | শষ্যদানা |
বাছা মাছ -৫২০ বেলে মাছ -৩৭০ ভেটকি মাছ -৪৮০ চেলা মাছের শুটকি-৩৫৯০ কাতলা মাছ -৫৩০ মাগুর মাছ -১৮০৪ খৈলশা মাছ -৪৬০ কই মাছ -৪১০ চিংড়ি -৩২৩ পুঁটি মাছ -১১০ রুই মাছ -৬৫০ চিংড়ির শুঁটকি -৪৩৮৪ শিং মাছ -৬৭০ টেংরা মাছ -২৭০ |
গরুর মাংস ১০ ডিম (হাঁসের) -৭০ ডিম (মুরগির) -৬০ মুরগীর মাংস -২৫ খাসির মাংশ -১২ খাসির কলিজা -১৭ ভেড়ার মাংস -১৫০ গরুর দুধ -১২০ ছাগলের দুধ -১৭০ দই -১৪৯ সন্দেশ-০২০৮ পায়েশ -৩৮৮ পান -২৩০ |
চাল -১০ ময়দা -৪১ আটা -৪৮ সেমাই -২২ সুজি -১৩ চিড়া -২০ সুরি -২৩ ছোলা -২০২ মাষ কলাই -১৫৪ মশুর ডাল -৭৫ মুগ ডাল -৭৫ চিনি -১২ রুটি -১১ |
শাক সবজি ফল/মসলা
লাউ শাক-৮০ কচু শাক-৪৬০ লেটু শাক-৫০ সরিষার পাতা-১৫৫ লাল শাক-৩৭৪ কলমি শাক-১০৭ কাঁচা মরিচ-১১
| পুঁই শাক-১৬৪ পাট শাক-১১৩ ডাঁটা শাক-৮০ মুলা শাক-২৮ ধনে পাতা-১৮৪ গাজর-২৭ সিম-২১০ বাঁধাকপি-৩১
| সিম বিচি-৬০ ঢেঁড়শ-১১৬ বরবটি-৩৩ ঝিঙা-১৬ কাঁচা পেঁপে-১৩ কাঁচা টমেটো-২০ বেগুন-১১ করল্লা -২৩
| পেয়ারা-২০ আম-১৬ ডাব-১৫ কাঁঠাল-২৬ কালো জাম-২২ পেঁপে-৩১ আমড়া-৫৫ কমলা-৪০ কলা-১৩
| তেঁতুল-১৭০ আপেল-৫৬ আমলকি-৩৪ বেল- ৩৮ বড়ই-১১ লিচু-৯০ রসুন-৩০ পেঁয়াজ-১০৪০ জিরা-১০৪০ হলুদ-১৫০ |
কতটা ক্যালসিয়াম প্রয়োজন :
১০-৩০ বছর বয়সীদের দৈনিক ১০০০-২০০০ মিলিগ্রাম
১০ বছরের কম এবং ৩০ বছরের বেশি বয়স্কদের দৈনিক ৮০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। রজঃনিবৃত্ত মহিলা ও যারা হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপীতে ছিল তাদের প্রতিদিন ১৫০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয়। গর্ভধারণ ও সন্তানকে স্তন্যদানের সময় প্রত্যহ ১৫০০ থেকে ২০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খাওয়ানো প্রয়োজন।
দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামের কম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিবে। স্বাভাবিকভাবে নিয়মিত সুষম খাদ্য খেলে শরীরের ক্যালসিয়ামের চাহিদা মিটে যায়। বাইরে থেকে ক্যালসিয়াম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বেড়ে উঠার সময় অর্থাৎ ১৫ বা ৩০ বছর পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয়।
সব ক্যালসিয়ামই এক নয় :
বাজার থেকে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কেনার সময় তাতে কি আছে তা দেখে নিন। ক্যালসিয়াম আরোটেট, ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট এবং ক্যালসিয়াম সাইট্রেট সবচেয়ে ভাল। এর প্রায় ৪০% ক্যালসিয়াম দেহে আত্তীকৃত হয়। ক্যালসিয়ামের কার্বোনেট ততটা কার্যকর নয়। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষের জন্য ক্যালসিয়াম কার্বোনেট কোনো কাজেই আসে না।
সতর্কতা :
কিডনীর সমস্যা, কিডনী বা মূত্রাশয়ে পাথর থাকলে ক্যালসিয়াম বড়ি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সেবন করবেন না। কোষ্ঠকাঠিন্য ও রক্তশূন্যতায় ভুগলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ক্যালসিয়াম খাবেন না। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম যৌথভাবে কাজ করে। তাই ক্যালসিয়াম বেশি গ্রহণ করলে ম্যাগনেসিয়ামের চাহিদাও বেড়ে যায়; তাই এর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।